মনজু, তুমি এমন কেন? তুমি কি একটুও আমাকে বোঝ না? তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, তোমার হাতে হাত রেখে পথ চলার জন্য, তোমার লোমশ বুকে মুখ ঘঁষবার জন্য আমার মনটা আকুলি বিকুলি করে! তোমার সেই প্রশ্নটা "বিয়ে করছোনা কেন?" উত্তরটা কি জানোনা তুমি নাকি হেঁয়ালি করো? বিয়েতো করতেই চাই। চাই একটি সাজানো গোছানো সংসার। কিন্তু, বিয়ের প্রস্তাবগুলো এলে মনে হয়, না না, আমার এখন বিয়ে করার অবসর নেই। আমার আরেকটু সময় দরকার। আরেকটু!
তুমি তো জানোনা সারাদিন কতটা মিস করি তোমায়। তুমি আছ আমার প্রতিটি মুহুর্তে, প্রতিটি সেকেন্ডে সেকেন্ডে।
সকালে ঘুম হতে জেগে কম্বলের ভেতরে হাতরে খুঁজে বের করি আমার মোবাইলটা আর ঘুমে অন্ধ চোখেই তোমাকে জানাই 'সুপ্রভাত'! তুমি হয়তো তখন রাত জেগে লেখালেখি করে বেশ দেরীতে ঘুমিয়েছো। আমি যখন তোমায় নক করেছি, তার কিছুটা পরে বিছানা ছাড়ার সময় হয়তো তোমার।এস এম এস টা পাঠিয়েই ফোনটা সাইলেন্ট করে দেই আর কিছুটা শংকিত হই। এই হয়তো তোমার ফোন আসবে আর ঝাড়ি খেতে হবে, "কেন করো এইসব?" তোমার ঘুম জড়ানো বিরক্তির লেশ পড়া মুখ মনে করি আর মনে মনে 'সরি' জানাই তোমাকে, "এবারটা ক্ষমা করো আমার মানিক"। তোমার ছবিতে একটা চুমু এঁকে মোবাইলটাকে বালিশের নিচে চালান করে দিয়ে চলে যাই ফ্রেশ হতে।দাঁত ব্রাশ করতে আর মুখ ধুতে ধুতে ভাবতে থাকি, ফিরে তোমার মিসকল বা এস এম এস পাবো। কিন্তু, ভাবাই সারা!! নাই কোন ফোন, নাই কোন বার্তা।
সকাল আটটা পনেরো এর মধ্যে স্কুলে পৌঁছে সাইন করতে হবে। এখনও বাসার কেউ জাগেনি। আমাকে এখনই নাশতার ব্যবস্থা করতে হবে, নিজের খাওয়া শেষ করে টিফিন রেডি করে নিজের সাজুগুজু শেষ করতে হবে। তাড়াতাড়ি কয়েকটা রুটি বানিয়ে সেঁকে নিলাম আর তোমার জন্য পরোটা-ডিম ভাজি। আসলে সবই আমার জন্যই। কিন্তু, আমার ভাবনায় তুমি সারাক্ষণই। তাই, আবার একটি এস এম এস করলাম, "নাশতা রেডি, তাড়াতাড়ি চলে এসো, সব জুড়িয়ে যাচ্ছে!" তুমি হয়তো তখন উঠেছ, অফিস যাওয়ার জন্য নিজেও নাশতা খেতে বসেছ, বা গোসল সেরে পোশাক পরছো। যাই হোক, তুমি আমার সাথে থাকলেই কি আর না থাকলেই কি, তোমার ছায়া তো আমার সাথেই থাকে!
নাশতা সেরে আলমারি খুলে কয়েক পলক থমকে থাকা। তুমি শাড়ি চুজ করে দিলে, আমি সেটা পরতে শুরু করলাম। পাজি ! নচ্ছার! চেয়ে দেখ কি! তুমি দেখছ ভেবে লজ্জায় লাল! আয়নায় নিজেকে দেখে শাল জড়িয়ে কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে অদৃশ্য তোমাকে মনে মনে, " চলো, বেরিয়ে পরা যাক!"
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় ভাবি,"এসো তো আর রাত জাগতে হবেনা। আমার পাশে এসো। শুধু কম্বলে কি শীত মানে? তুমি বসে থাকবে আর আমি একা একা ঘুমোবো! কম্বলের চেয়ে তোমার শরীরের উষ্ঞতা বেশি লোভনীয়।
: কিরে শিল্পী, টেবিলে বসে ঘুমাচ্ছিস কেন?
মা কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন টের পায়নি শিল্পী। ছবি আঁকা বাদ দিয়ে কখন টেবিলে এসে বসেছে ও,মনে পড়লোনা। মনজুকে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, নাকি জেগে জেগে কথা বলছিলো ও লোকটার সাথে! মা কি শুনে ফেলেছে কিছু!
: বিছানায় গিয়ে আরাম করে ঘুমা। আর বেশি রাত জাগিস না। -মা বলে উঠলেন আবার।
: এইতো মা শুবো। তুমি যাও।
মা চলে গেলে আবার ভাবনা্য় ডুবে গেলো সে। মানুষটিকে সে নিজের চোখে দেখেনি। শুধু ছবি দেখেছে। কি সুন্দর ফিগার! আর কি লম্বা! পাঁচ ফুট নয় ইন্ঞি। একেবারে ওর মনের মত। পুরুষের এই হাইটটি ওর সবচেয়ে পছন্দ। পুরুষ মানুষ হিসেবে ও একটু শুকনা। তবে ওর বাকি সবকিছু মিলিয়ে এটা কোন খুঁতই নয়। সবাইকি পারফেক্ট হয়! অসাধারণ দুটি বড় বড় চোখ ওর। একেবারেই আলাদা। অন্য কারো সাথেই মিলেনা। ঐ চোখ সে বেশিরভাগ সময়েই সানগ্লাস দিয়ে ঢেকে রাখে। কারণটা জানেনা ও। কিন্তু, শিল্পীর নিজের ধারনা, ঐ চোখ ঢেকে রাখাই ভালো। তাকানো যায়না ঐ চোখে। খুন হয়ে যেতে হয়। যেমন হয়েছে ও নিজে। মনে মনে বলে ওঠে...
...ঐ চোখ ঢেকেই রাখো মনজু
আমায় করেছ খুন
আর কারো করোনা সর্বনাশ।
"তোমার চোখেতে ধরা পরে গেছি আজ/ তোমার চোখেতে ধরা পরে গেছি আজ" ...গুনগুনিয়ে গানটা গাইতে গাইতে প্লেটে রং মেশাতে মেশাতে ইজেলে লাগানো ক্যানভাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ছবিটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। সামনেই মনজুর জন্মদিন।এবস্ট্রাক্ট মুডের ছবি খুব পছন্দ ওর। সে নিজেও করে। কিন্তু, প্রথম দিকে রিয়েলিস্টিকই বেশি আঁকতো। এবস্ট্রাক্ট ছবি আঁকা শুরু মনজুর কথাতেই। বলা যা্য়, ও-ই ওর অনুপ্রেরণা।
বুয়েট থেকে এম.এস.সি ইন্জিনিয়ার বিসিএস অফিসার এই লোকটির সাথে শিল্পীর পরিচয়ের সূত্রতা আবছা হয়ে এলেও প্রথম ফোনে কথা বলার মুহূর্তটা এখনো কানে বাজে।
: সারাদিন বাসায় বসে কি করেন? চলে আসুন না আজ আমাদের আড্ডায়!
এত সুন্দর কন্ঠস্বর! পরিস্কার উচ্চারণ। মনে হয় সারাক্ষণ কথা বলে। কথা শুনে। লোকটা বয়সে বছর দু-তিন সিনিয়র হবে ওর চেয়ে। প্রাণবন্ত যুবক! গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে থাকে। আর দেখলে মনে হয়, পাত্তা দিতে চায়না। একটু আড়াল রাখার ব্যর্থ চেষ্টা?
লোকটা একটু মুডি। শিল্পী বোবা টাইপের নয়। একেবারে নতুন কারো সাথেও দিব্বি জমিয়ে তুলতে পারে। মনজুর সাথেও প্রথম বেশ কথা বলতো। কিন্তু, ওকে নিয়ে ভিন্ন করে ভাবতে শুরু করার পর থেকেই সরাসরি কথা বলতে গিয়ে সহজ হতে পারেনা আর। লোকটা একটু কম কথা বলে। তবু, ফোন করলে কথাতো বলেই। ইচ্ছে হলেই ফোন করা যা্য়। কথাও বলা যা্য়। কিন্তু, ফোন করার জন্য রেডি হয়েও শিল্পীর ইতস্তত ভাবটা কাটেই না। ফোন করে কি বলবে? কোন কারনতো নেই। অথচ, সে সারাক্ষণ মনজুর সাথে কত কথার জাল বুনে যায়।
মনজুর লেখা কবিতাগুলো খুব ভালো লাগে ওর। তবে, বেশিরভাগ কবিতায় বিষন্ণতা। শিল্পীর ইচ্ছে হয় বলে, কবি তুমি আমার কাছে এসো, তোমার সব দু্ঃখ ঢেকে দেবো। আমার রং-তুলি দিয়ে তোমার সব দুখের রং ঢেকে দিয়ে রংধনুর রঙে রাঙিয়ে দেবো আর বানাবো তোমার আমার ভালোবাসার বৃন্দাবন।
শিল্পী জানে বৃথাই বোনা তার এই সব স্বপনের জাল। মনজুকে খুব ভালো ভাবে চেনা ওর এক বন্ধু বলেছিলো ওকে, " তুই অযথাই মনজু ভাইয়ের পথ চেয়ে বসে আছিস রে! ওনার সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করার ইচ্ছে। তোর কোন চান্স নেই।"
শিল্পীরও তাই মনে হয়। নইলে ও কেন একটু ফিরে তাকায় না? এত যে সকাল-সন্ধা এসএমএস; এমনকি মাঝে মাঝে খুব গভীর রাতেও, সেইসব কি এমনি এমনি! 'একটা বর খুঁজে দিন না' বলে বলে কান ঝালাপালা করা, এসবের অর্থ কি সে একটুও বোঝে না? বর না ছাই! ও যে ওকেই চা্য়! হঠাৎ খুব মন খারাপ হয়ে যায় ওর। পুরুষগুলো চেহারার সৌন্দর্যের মধ্যে কি পায়! মনজুর কি ধারনা ও পারবেনা মনজুকে খুশি করতে? ও নাহয় চেহারায় সুন্দরী নয়। কিন্তু, পুরুষের কাম্য বলে কিচ্ছু কি নেই ওর! আর, লম্বা মেয়েদেরই তো এখন চাহিদা। আর, পড়াশুনায় ও খারাপ ছিলোনা কখনই, তবে একটু সিরিয়াস হয়ে পড়াশুনা করলে সব ফার্স্ট ক্লাস রাখতে পারতো।
শিল্পীরা বিশাল ধনী না হলেও অবস্থা খারাপ নয়। মধ্যবিত্ত। ঢাকা শহরে ওদের নিজেদের ফ্লাটেই থাকে। তাও ধানমন্ডি এলাকায়। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। সবাই ওর বিয়ের চেষ্টা করছে। আঠাশ পেরিয়ে যাওয়া মেয়ের জন্য বাবা-মায়ের ভাবনা হবে এটাইতো স্বাভাবিক। ভালো ভালো প্রস্তাবও আসে। ভালো পেশায় নিয়োজিত সুন্দর সুন্দর পাত্র। অপছন্দনী্য় নয়। ফেলনা নয়। কিন্তু, ও রাজী হতে পারেনা। এদিকে ওর পিঠাপিঠি ছোট ভাইটাও নিজের বিয়ের জন্য পাত্রি খোঁজার ঘোষণা দিয়েছে। তবে, তার আগে একমাত্র বোনের শুভকাজটা সম্পন্ন করতে আগ্রহী। মাকে ফোন করে করে প্রায়ই তাগাদা দেয় নিউ ইয়র্কে পিএইজডি করতে যাওয়া এই ভাইটা।
বেশ রাত হয়ে গেছে। এখন ঘুমাতে যাওয়া দরকার। মনজু তুমি এখন কি করছো? দেশের বাড়ি গেলে কেন এই শীতের মধ্যে হঠাৎ! তাও কোন ছুটির দিনে নয়! তবে কি বিয়ে করতে যাচ্ছ? খুব খুশি খুশি মেজাজ দেখলাম। ঐ কাজ করোনা তুমি প্লিজ! প্লিজ তুমি আর কারো হাত ধরোনা। আমি যে মরে যাবো! তুমি আমার হয়ে দেখো কিরকম বদলে দেই তোমার জীবনটা! তোমার নিঃসংগ রাতের সংগী করে নাও আমাকে। ঠকবেনা। ভালোবাসা আর আদরে ভাসিয়ে দেবো। নির্ঘুম রাত কাটবেনা আর। প্রতিটি রাত হবে এক একটি আনন্দঘন সোনালি স্মরনীয় রাত! তোমার কষ্ট করে গল্প বা কবিতাগুলো টাইপ করতে হবে না। আমি তোমার পরিশ্রম কমিয়ে দেবো শতভাগ। তোমার জোৎস্না রাতে আমায় বাঁশির সুরে পাগল করবে। তোমাকে না পেলে আমার এই জীবণই বৃথা। তোমার ঐ ঠোঁটের আদর শুধু আমার !শুধু আমার!
আমি তোমায় মুখ ফুটে বলতে পারিনা। কিন্তু তুমি তো একবার আমায় বলতে পারো। তোমার মুখে শোনার জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাকে? বুড়ি হয়ে গেলে! কবি নির্মলেন্দু গুন এর গল্পের নায়িকার মত তখন বলবো তোমায়-আমার ঈশ্বর জানেন, আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য, আমার ঈশ্বর জানেন, আমার জ্বর এসেছে তোমার জন্য, আমার ঈশ্বর জানেন, আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য। তারপর ঐ ঈশ্বরের মতো কোনো একদিন তুমিও জানবে, আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য, শুধুই তোমার জন্য।
কোল বালিশটা শক্ত করে জড়িয়ে মনজুর প্রতি অদৃশ্য একটা চুমু এঁকে শুভরাত্রি জানিয়ে একা একা মনে মনে কথা বলতে বলতে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো শিল্পী। মনজু এখন কি করছে কে জানে। হয়তো কোন সুন্দরীর স্বপ্ন আঁকছে। বা, লিখছে নতুন কোন লেখা। অথবা, সে-ও হয়তো শোয়ার আয়োজন করছে। নাকি "শুভ-রাত্রি" লেখা শিল্পী নামের এক অচেনা মেয়ের এসএমএস পড়ছে! হয়তো জেগে আছে নির্ঘুম। হয়তো...এরকম কতকিছুইতো হতে পারে।
লিখেছেন :
জাকিয়া জেসমিন (জুথি) সম্পাদনা ১৬ জানুয়ারি (শনিবার), ২০১০ ১২:২৬ অপরাহ্ন